বিটরুট, যা আমাদের সাধারণ ভাষায় বিট নামে পরিচিত, একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এটি  লাল রঙের এবং এর গাঢ় রঙের কারণে এটি আমাদের চোখে পড়ে এবং এটি অনেকের পছন্দের। বিটরুটে থাকে বিটানিন পিগমেন্ট, যে কারণে বিটরুটের রং লাল হয়। এই বিটানিন হলো এক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টও, যা শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী হিসেবে কাজ করে। বিটরুটের মূল খাওয়ার ক্ষেত্রে এটি শুধু একটি স্বাদবান উপাদান নয়, বরং এটি ভিটামিন সি জাতীয় ফল হিসেবেও পরিচিত। শীতকালে এ সবজির উৎপাদন বেশি হলেও বর্তমানে সবসময়ই এ সবজির দেখা মেলে। বিভিন্ন পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন এ সবজিটিকে সুপারফুডও বলা হয়ে থাকে। বিটরুটের বিভিন্ন পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানলে আমরা এর ব্যবহারকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে পারি।  

 

বিটরুট এর পুষ্টিগুণ

বিটরুট সম্পূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি সবজি। এটি মূলত ভিটামিন এবং খনিজের একটি সেরা উৎস।  বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন সি, ভিটামিন B6, ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম, ফোলেট এবং আয়রন রয়েছে। এইসব পুষ্টিগুণ আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটে থাকে অসংখ্য পুষ্টিগুণ যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণভাবে উপকারী।   

ভিটামিন সি: বিটরুট ভিটামিন সি-এর উৎকৃষ্ট উৎস, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি ত্বককে উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান রাখে এবং রক্ত সঞ্চালন ভালো করে, ফলে তা স্বাস্থ্যকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে। এছাড়া এটি ত্বক, হাড় এবং দাঁতের জন্যও উপকারি। 

ফাইবার: বিটরুট একটি পুষ্টিকর সবজি যা ফাইবারে সমৃদ্ধ। এটি পাচন স্বাস্থ্য উন্নত করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বিটরুটের ফাইবার হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তে শর্করার স্তর নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য বিটরুট অপরিহার্য।

ফোলেট: বিটরুট ফোলেটের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। ফোলেট রক্ত সৃষ্টিতে সাহায্য করে এবং শরীরের কোষ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি গর্ভাবস্থায় গর্ভস্থ শিশুর উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য যা শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বিশেষ সহায়ক।  

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: বিটরুট একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরকে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে রক্ষা করে। এতে বিটালাইন, ভিটামিন সি এবং ফেনোলিক উপাদান রয়েছে, যা ইমিউন  সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং কোষের ক্ষতি রোধ করে। বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা আমাদের দেহের ক্ষতিকারক কণা ও টক্সিন থেকে রক্ষা করে। 

বিটরুট এর স্বাস্থ্য উপকারিতা 

বিটরুট খাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এর নানা উপকারিতা পাওয়া যায়।  অনেকেই বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধ ও শরীরকে ভালো রাখতে দীর্ঘদিন ধরে বিটরুট ব্যবহার করে আসছেন। 

এখানে বিটরুটের কিছু প্রধান উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ

বিটরুটে প্রচুর নাইট্রেট থাকে, যা রক্তনালী সম্প্রসারণে সাহায্য করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত বিটরুট সেবন করলে শরীরের রক্তপ্রবাহ উন্নত হয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। বিটরুট শরীরের রক্তপ্রবাহ উন্নত করে ফলে আমাদের হৃৎপিণ্ড শক্তিশালী হয় এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে বিটরুট আপনার জন্য একটি কার্যকরী খাদ্য হতে পারে।

  • হজম প্রক্রিয়ার উন্নতি 

বিটরুট হজমের উন্নতিতে সহায়ক একটি অসাধারণ খাদ্য। এতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে নাইট্রেট, যা রক্ত সঞ্চালন এবং শরীরের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বিটরুটে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এবং ফাইবার শরীরের বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া এটি পেটের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই, নিয়মিত বিটরুট খাওয়া স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য একটি চমৎকার পছন্দ।  

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

বিটরুট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত কার্যকরী। এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। বিটরুট রক্তে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা বাড়ায়, যা দেহে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত বিটরুট খেলে সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। 

  • শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়

যারা অ্যাথলেট বা নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়াম করেন, তারা নিয়মিত বিটরুটের জুস খেতে পারেন। অ্যাথলেটদের প্রচুর শক্তির দরকার। বিটে থাকা নাইট্রেট শরীরের কোষে শক্তি উৎপাদক মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। আর এতে শারীরিক কর্মক্ষমতাও বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিটের জুস শরীরের সহনশীলতা ও কার্ডিওরেসপিরেটরি কর্মক্ষমতা বাড়ায়। বিটরুট খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চিত হয়। এটি খেলোয়াড় এবং ব্যায়াম প্রেমীদের জন্য একটি বিশেষ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। 

  • যকৃতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় 

বিটরুট যকৃতের সুরক্ষায় বিশেষভাবে উপকারী। এতে থাকা বেটাইন যকৃতের ফ্যাট কমাতে সহায়তা করে এবং টক্সিন দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহরোধী গুণাগুণ যকৃতের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত বিটরুট খেলে যকৃতের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন লিভারজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়। এটি লিভারের ক্ষতিকর পদার্থগুলো দূর করতে সাহায্য করে এবং যকৃতকে পরিষ্কার রাখে।  

  • ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা 

বিটরুট ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এতে থাকা ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস ত্বকের বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত বিটরুট খেলে ত্বক উজ্জ্বল ও কোমল থাকে। এছাড়া বিটরুট রক্ত পরিশোধন করে, যা ব্রণ প্রতিরোধ করে এবং ত্বকের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে।

  • যৌন স্বাস্থ্যর উন্নতি  

বিটরুট যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বিশেষভাবে কার্যকর। এতে উপস্থিত নাইট্রিক অক্সাইড রক্ত প্রবাহ বাড়ায়, যা যৌন কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া, বিটরুটে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যৌন হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক। যৌন উত্তেজনা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে বিটরুটের প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা সামগ্রিকভাবে যৌন স্বাস্থ্যের উন্নত সাধন করে। 

  • প্রদাহ বিরোধী ক্ষমতা

বিটরুটে থাকা বিটালেইনস নামে এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ বিরোধী ক্ষমতা রাখে। এটি শরীরের ফ্রি র‍্যাডিক্যালস হ্রাস করে কোষকে সুরক্ষা দেয়। প্রদাহজনিত সমস্যা যেমন আর্থ্রাইটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে বিটরুট বেশ সহায়ক। নিয়মিত বিটরুট খাওয়া শরীরের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া কমিয়ে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে।

বিটরুট খাওয়ার নিয়ম

বিটরুট খাওয়ার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। নিচে কিছু জনপ্রিয় উপায় উল্লেখ করা হলো:

স্যালাডে ব্যবহার: বিটরুট কাঁচা বা সেদ্ধ করে স্যালাডে ব্যবহার করা যায়। এটি স্বাদে ও পুষ্টিতে সমৃদ্ধ।

সুপ: বিটরুটের সুপ তৈরি করে খাওয়া যায়। এতে অন্যান্য সবজির সঙ্গে মিলিয়ে এটি আরো পুষ্টিকর হয়। 

জুস: বিটরুটের রস খুবই জনপ্রিয়। এটি স্বাস্থ্যকর এবং সহজে তৈরি করা যায়।

পাকানো খাবার: বিটরুট দিয়ে নানা ধরনের খাবার যেমন চাটনি, কেক ও পুডিং প্রস্তুত করা   যায়।

শুকনো বিটরুট: শুকনো বিটরুট স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া যায়। 

বিটরুট খাওয়ার কিছু বাধ্যবাধকতা 

  • নিম্ন রক্তচাপের রোগীদের জন্য বিটরুট ক্ষতিকর। কারণ এটি রক্তচাপ আরও কমিয়ে দিতে পারে। 
  • বিটরুট শরীরের জন্য অনেক উপকারী কিন্তু এটিকে নিয়মিত না খেয়ে সপ্তাহে ৩-৪ দিন খাওয়ায়  ভালো।   
  • যারা কিডনিতে পাথরের সমস্যায় ভুগছেন তাদের বিট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • বিটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অত্যন্ত বেশি। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। 
  • অ্যালার্জির সমস্যা হলে এটি খাওয়া উচিত না। কারণ এর ফলে ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি, জ্বালাপোড়া হতে পারে।

পরিশেষে

বিটরুট একটি অসাধারণ পুষ্টিকর খাদ্য যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকার নিয়ে আসে। এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা জানার পর আমরা সহজেই বুঝতে পারি কেন এটি আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি একটি রঙিন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার যা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে। বিটরুটের ব্যবহার ও খাওয়ার নিয়মকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা আমাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারি এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারি। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে বিটরুট যুক্ত করা উচিত, যাতে আমরা এর সমস্ত সুবিধা পেতে পারি।  

Posted in
#Health Tips

Post a comment

Your email address will not be published.

Select the fields to be shown. Others will be hidden. Drag and drop to rearrange the order.
  • Image
  • SKU
  • Rating
  • Price
  • Stock
  • Availability
  • Add to cart
  • Description
  • Content
  • Weight
  • Dimensions
  • Additional information
Click outside to hide the comparison bar
Compare